জিজ্ঞাসা

কাকে বলবো ‘মাদকনির্ভরশীলতা’?

ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, ট্যাবলেট (সেডিল, ইউনকটিন ইত্যাদি), মদ, ফেনসিডিল, ইনজেকটিং ড্রাগ (প্যাথেডিন, টিডিজেসিক, ইত্যাদি) বেশ কিছুদিন ধরে অপব্যবহারের ফলে ব্যক্তি একসময়ে এসকল মাদক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে মাদক নেওয়ার জন্য তীব্র টান অনুভব করে। মাদক নিতে না পারলে ব্যক্তি অসহ্য শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে, এমনকি তার পক্ষে স্বাভাবিক কাজ-কর্ম চালিয়ে যাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবহারের ফলে শারীরিক-মানসিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েও এবং অনেক সময়ে ইচ্ছে থাকলেও নিজে নিজে মাদক গ্রহণ ছেড়ে দেওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। এই অবস্থাটিই ‘মাদকনির্ভরশীলতা’– অনেকে এটিকে ‘মাদকাসক্তি’ও বলে থাকেন।

মাদকনির্ভরশীলতা কোনো রোগ নয়, বরং এটি একটি কুঅভ্যাস। অনেকদিন ধরে মাদকব্যবহার করতে করতে কুঅভ্যাসটি গড়ে উঠে।

 

মাদকনির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসা কি সম্ভব?

অবশ্যই সম্ভব! যদিও অনেকেই মনে করেন, মাদকনির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মাদকগ্রহণকারীদের মধ্যে একটা অংশ নিজের চেষ্টাতেই মাদক ছেড়ে দিতে পারেন। তবে অনেকের পক্ষে শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় মাদকনির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয় না। কার্যকর চিকিৎসা নিয়েই কেবল এরা মাদকসমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

মাদকনির্ভরশীলতা থেকে কার্যকরভাবে মুক্ত হতে প্রয়োজন সমন্বিত চিকিৎসা

 

বাংলাদেশে মাদকনির্ভরশীলতার কী চিকিৎসা চালু আছে?

বাংলাদেশে মাদকনির্ভরশীলতার দুধরনের চিকিৎসা আছে: মেডিকেল ডিটক্সিফিকেশন ও পুনর্বাসন চিকিৎসা।

মেডিকেল ডিটক্সিফিকেশন

এতে  প্রথমেই ব্যক্তির মাদক নেওয়াকে বন্ধ করা হয়। মাদক গ্রহণ বন্ধ করার ফলে প্রত্যাহারজনিত শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ দেখা দেয়, যেমন: বমি, পাতলা পায়খানা, হাত-পা চাবানো, অস্থিরতা, উত্তেজনা, ঘুমের সমস্যা, ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের ঔষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে এসকল উপসর্গের চিকিৎসা করা হয়। স্বল্পমেয়াদি এই চিকিৎসা (৭-১৫ দিন) দেশের বিভিন্ন ক্লিনিকে (ইনডোর/আউটডোর) ডাক্তার ও সাইকিয়াট্রিস্টদের তত্ত¡াবধানে পরিচালিত হয়ে থাকে। মাদকনির্ভরশীলতার চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিকভাবে না জানার কারণে অনেক অভিভাবক এটিকেই পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা মনে করেন। অথচ এটি চিকিৎসার প্রথম ধাপ মাত্র।

পুনর্বাসন চিকিৎসা

মাদকনির্ভরশীলতার চিকিৎসায় পুনর্বাসন শব্দটি পুনরায় আবাসন অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ মাদক ব্যবহার করে ব্যক্তি যা হারিয়ে ফেলেছে চিকিৎসার মাধ্যমে তা ফিরে পায়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার ভেতর দিয়ে একজন মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তি শারীরিক-মানসিক ক্ষতি ও পারিবারিক-সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠে মাদকমুক্ত জীবনের সুস্থ ধারায় ফিরে আসে।

এই পদ্ধতির শুরুতেই ব্যক্তিকে চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করা হয় এবং পরে তাকে ডিটক্সিফিকেশনের আওতায় নেওয়া হয়। ডিটক্সিফিকেশনের পরে এই চিকিৎসায় প্রধানত মাদক বিষয়ে শিক্ষা, মাদকের টান নিয়ন্ত্রণ ও পুনরায় মাদক ব্যবহার রোধে বিভিন্ন ধরনের স্কিল বা কৌশল এবং ব্যক্তির আচরণিক ও মানসিক নানা সমস্যা সমাধানে প্রশিক্ষণ ও বিজ্ঞানসম্মত থেরাপি প্রয়োগ করা হয়।

পুনর্বাসন চিকিৎসায় মাদকব্যবহারকারী ব্যক্তিকে তার মাদকনির্ভরশীল হয়ে পড়ার পুরো প্রক্রিয়াটা বুঝতে সাহায্য করা হয়। পাশাপাশি, কেন সে মাদক ব্যবহার করে চলেছে তাও ধরিয়ে দেওয়া  হয়। এছাড়াও, কোন্ কোন্ পরিস্থিতে সে আবার মাদক ব্যবহার করতে পারে সে বিষয়ে সচেতন করা এবং তা ঠেকানোর জন্য দরকারি শিক্ষা ও কৌশল রপ্ত করানো হয়।

এই পদ্ধতিতে ব্যক্তি কাজ, দ্বায়িত্ব পালন, বিনোদন-খেলাধূলা ও বিশ্রামের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন-যাপনের অভ্যাস গড়ে তুলে এবং এভাবে নিজেকে মাদকের টান থেকে রক্ষা করে। মেডিকেল ডিটক্সিফিকেশনের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি এই পুনর্বাসন চিকিৎসায় ব্যক্তি নিজেই তার সুস্থতার মূল দায়িত্ব নিয়ে নেয়।

 

দেশে প্রচলিত মেডিকেল ডিটক্সিফিকেশনের চেয়ে পুনর্বাসন চিকিৎসা কেন বেশি কার্যকর?

মাদকের প্রতি মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তির তীব্র টান বারে বারে এমনকি চিকিৎসার পরেও ফিরে আসতে পারে। কিন্তু, প্রচলিত ডিটক্সিফিকেশন চিকিৎসায় এই টান থামানোর কৌশল রপ্ত করানো হয় না। ফলে চিকিৎসার পরেও ব্যক্তি মাদকের টান থামাতে না পেরে আবার মাদক ব্যবহার শুরু করে।

অন্যদিকে পুনর্বাসন চিকিৎসায় মাদকদ্রব্যের প্রতি তীব্র টান নিয়ন্ত্রণের উপায় এবং পুনরায় মাদক নেওয়া থেকে বিরত রাখতে টান থামানোর বিভিন্ন কৌশল ব্যক্তিকে শিখানো হয়। এছাড়া মাদকের প্রতি ব্যক্তির ঝোঁককে জিইয়ে রাখে এমন শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কারণগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর ওপর বিভিন্ন বিজ্ঞানসম্মত থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। ফলে, চিকিৎসার পর ব্যক্তির মাদক নেওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে আসে।

এছাড়া, মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তির শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক-আচরণিক-আবেগীয়-নৈতিক ও কাজের (চাকুরি, ব্যবসা, লেখাপড়া) যে ক্ষতি এবং পারিবারিক-সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় শুধুমাত্র ডিটক্সিফিকেশন চিকিৎসায় তা কোনোভাবেই পূরণ হওয়া সম্ভব নয় বরং এই ক্ষতির চাপ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে চিকিৎসাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সহজেই খাপ খাওয়ানোর পুরনো কৌশলে  ফিরে যেতে পারে অর্থাৎ আবার মাদক নেওয়া শুরু করতে পারে।

অন্যদিকে, পুনর্বাসন চিকিৎসায় বিভিন্ন থেরাপি প্রয়োগের মাধ্যমে এইসব ক্ষতি ও পারিবারিক-সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে ব্যক্তিকে কাজের প্রতি আগ্রহী, ভারসাম্যপূর্ণ একটি জীবনে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করা হয়।

তাই মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তিকে মাদক মুক্ত জীবনে ফিরিয়ে আনতে হলে পুনর্বাসন চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই।

উল্লেখ্য, পাশ্চাত্যে পুনর্বাসন পদ্ধতিই মাদকনির্ভরশীলতার প্রধান চিকিৎসা।

 

পুনর্বাসন কেন্দ্র বাছাই করার ব্যপারে সতর্ক থাকা দরকার

দেশের কয়েকটি পুনর্বাসন চিকিৎসা কেন্দ্রের সাফল্যের কারণে বেশ কিছু ক্লিনিক বা ডিটক্সিফিকেশন সেন্টার পুনর্বাসন নাম ব্যবহার করছে অথচ পুনর্বাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানই সেগুলোতে দেখা যায় না। চিকিৎসাব্যবস্থার এই অসম্পূর্ণতার কারণে এসব কেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তি ও তাদের অভিভাবকরা ভালো ফলাফল না পেয়ে গোটা মাদকনির্ভরশীলতার চিকিৎসা নিয়ে বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়ে পড়ছেন। সুতরাং, কার্যকর চিকিৎসা পেতে হলে সঠিক পুনর্বাসন কেন্দ্র বাছাই করা জরুরি।

 

‘ক্রিয়া’-র পুনর্বাসন চিকিৎসা?

‘ক্রিয়া’ -র চিকিৎসাব্যবস্থায় পুর্বাসন চিকিৎসার প্রায় সকল উপাদানই রয়েছে। এগুলো হচ্ছে:

মটিভেশন/কনসালটেশন

এ্যাসেস্‌মেন্ট

মেডিকেল চেক-আপ

ডিটক্সিফিকেশন

ব্যক্তিগত কাউন্সেলিং

পারিবারিক কাউন্সেলিং

সাইকোএডুকেশন/শিক্ষামূলক ক্লাস

রিল্যাপ্স প্রিভেনশন প্ল্যানিং

কগনিটিভ বিহেভিয়র থেরাপি

গ্রুপ থেরাপি

ওয়ার্ক কন্ডিশনিং

পারিবারিক সম্পর্কোন্নয়ন

বিনোদন ও খেলাধুলা

রিল্যাক্সেশন ও মেডিটেশন

গ্রুপ মিটিং

পারিবারিক মিটিং ও ক্লাস

ফলো-আপ ও আফটার-কেয়ার

আত্মসহায়ক দল ও ফেলোশিপ

‘ক্রিয়া’ প্রতিটি কেন্দ্র ডাক্তার, কাউন্সেলর, মাদকমুক্ত সুস্থ ব্যক্তি (রোল- মডেল), চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী /মনোবিজ্ঞানী, সাইকিয়াট্রিস্ট, সমাজকর্মী, ভকেশনাল ট্রেনার, আইনি পরামর্শদাতা, নানা ধরনের প্রশিক্ষক নিয়ে গড়া একটি টিম ‘থেরাপিউটিক কমিউনিটি’র পরিবেশ তৈরি করে উল্লেখিত চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকে ।

 

‘ক্রিয়া’-য় চিকিৎসার মেয়াদ?

মূল চিকিৎসার মেয়াদ ৩ মাস (আবাসিক)। আবাসিক চিকিৎসা শেষে ১ মাসের অনাবাসিক (প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত) ফলো-আপ চিকিৎসা দেওয়া হয়। তিন মাসের চিকিৎসাশেষে চিকিৎসাপরবর্তী সেবা দেওয়া হয়।